যেতে হবে বহুদূর

আয়নার দিকে তাকিয়েই চিৎকার করে উঠে প্রমি!
এটা কার চেহারা? এটা তো প্রমির চেহারা না। নাকি এটা কোনো দুঃস্বপ্ন? নিজের চেহারায় হাত বুলাতে থাকে সে। না, অনুভব করতে পারছে সে সবকিছু। এটা স্বপ্ন হতে পারে না, এটা বাস্তব! কিন্তু তার চেহারার এই অবস্থা হল কী করে? মনে হচ্ছে কেউ এসে থাবা দিয়েছে। পুরো মুখ বিকৃত হয়ে গেছে। প্রমির কত সুন্দর একটা তিল ছিল।
নেই! তিলটাও নেই।
একটুর জন্য চোখটা বেঁচে গেছে। চোখটা কেনো গেলো না? অন্তত এই বিকৃত চেহারা দেখা লাগত না। কীভাবে হলো এত কিছু? কীভাবে!? হাতের কাছের ফুলদানিটা দিয়ে আয়নাটা ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেললো প্রমি। হাঁটু ভেঙে মেঝেতে বসে পড়ল প্রমি। চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো সে।
‘প্রমি, কী হলো তোর?’ তাকিয়ে দেখে তার মা।
মা কেন এসেছে? সান্ত্বনা দিতে? সে জানে তার মা এখন তাকে কী বলবে। লাভ নেই। প্রমি জানে তার মাকে এখন তার জন্য কত কষ্ট পোহাতে হবে। হয়ত তার জন্য তার মা সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন না। কোথাও যেতে পারবেন না। কিন্তু এখানে তার কী দোষ? সে তো কোনো খারাপ কাজ করেনি। তাহলে তার জন্য কেন তার পরিবারকে কষ্ট পোহাতে হবে? নাকি দুনিয়ার নিয়ম এটাই, নির্দোষদের সব কষ্ট করতে হয়? প্রমি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তার মা তাকে ঘুম শান্ত করে ঘুম পাড়িয়ে। শাড়ির আঁচলে চোখের পানি লুকিয়ে প্রমির রুম থেকে বেড়িয়ে যান।
“ক্রিং! ক্রিং!” মোবাইলের মেসেজের শব্দে ঘুম ভাঙে প্রমির। কীসের মেসেজ এই অসময়ে? বিরক্ত হয়েই মোবাইলটা তুলে নেয় প্রমি। দেখে তার গানের অডিশনের মেসেজ। সে ঢাকার মধ্যে ২য় হয়েছে। সামনের আরেকটা ধাপ পেরুতে পারলেই ফাইনাল। কিন্তু কী হবে আর ওসব দিয়ে? কী নিয়ে সে যাবে সবার সামনে? তার এই মুখ নিয়ে? তার মুখের কি কোনো অস্তিত্ব আছে আদৌ?
নেই, কোনো লাভ নেই। সে কলেজে গেলেও তাকে নিয়ে অনেক কথা হবে। সবাই জিজ্ঞেস করবে, হাসাহাসি করবে। কিন্তু কী দোষ প্রমির? কার কী ক্ষতি করেছিল সে?
কলেজ রোডের মাথায় ঐ ছেলেটা প্রতিদিনই তার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতো। প্রমিকে দেখলেই উশখুশ করত। একদিন ছেলেটা প্রমিকে তার প্রেম নিবেদন করে বসে। প্রমি সবসময় ওসব ব্যাপার থেকে সরে থাকতে চায়। তাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটার প্রেম নিবেদন ফিরিয়ে দিলো। তাহলে কি এটাই ছিল তার দোষ? হ্যাঁ, ঐ ছেলেটাই তো। সেদিন কলেজের প্র্যাক্টিকাল ক্লাস শেষে বাসায় ফিরছিল। হঠাত করে ঐ ছেলেটা তার সামনে এসে প্রমিকে ধমকের সড়ে দাঁড়াতে বলে। প্রমি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। হঠাত মুখের উপর কিছু একটা পড়ে, প্রচন্ড যন্ত্রনায় প্রমি চিৎকার শুরু করে। আশেপাশের মানুষ সবাই এগিয়ে আসে। আর তারপর? তারপর আর কিছু মনে নেই প্রমির। কিন্তু এখানে প্রমির দোষ কোথায়? সে কেন হাসির পাত্র হবে? তার জন্য কেন তার মা-বাবা সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না? এর থেকে নিজের অস্তিত্বকে নষ্ট করা কি ভালো না? হ্যাঁ, তাহলেই তো সব চুকে যায়। শুধুমাত্র কিছু সময়ের ব্যাপার। ঐ যে ওড়নাটা, ওটা ঝুলিয়ে একটা গিঁট দিতে পারলেই তো হয়। প্রমি বুঝে যায় তাকে কী করতে হবে।
থমকে যায় প্রমি। ওড়নায় গিঁট দিতে পারে না। তার চোখ আটকে যায় তার মা বাবার দেয়ালে ঝুলানো ছবিটার দিকে। কী সুন্দর হাসি তাঁদের! যদি নিজের অস্তিত্বকেই বিলীন করে দেয় সে, তাহলে কি এই হাসিমুখ আর দেখতে পারবে? আর কোনো কিছুই তো সে উপলব্ধি করতে পারবে না। নিজেকে শেষ করলে, তার বেহালা কে বাজাবে? হঠাত করেই তার মনে পড়ে গানের অডিশনের কথা। এই মেসেজটার জন্য সে কত অপেক্ষা করেছে। এখন কি সেসব মুল্যহীন? শুধুমাত্র আজ সে এসিডের স্বীকার বলে? তার মানে কি? মৃত্যুই এর সমাধান? অবশ্যই না! মৃত্যু এর সমাধান নয়। এইতো সেদিনের একটা প্রতিবেদনে সে পড়েছিল শামীমা নামের একটা মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন এসিডের সম্মুখীন হয়েও, বর্তমানে সে ফ্যাশনের উপর অনার্স পড়ছে। সে বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে সারা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে চায়। শামীমা নামের মেয়েটা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী হয়ে পেরেছিল। তাহলে প্রমি কলেজের ছাত্রী হয়ে পারবে না কেন?
এভাবেই সব খারাপ ব্যাপার শেষ হয়ে যায়। কিন্তু সেই খারাপ ব্যাপার কখনই আমাদের জীবন কে শেষ করতে পারেনা, পারবেও না।
জীবনের বড় বড় বিপদগুলো কাউকে শেষ করে দিতে আসে না। আসে জীবনের নতুন পথ খুঁজে দিতে। এভাবে মৃত্যুকে টেনে নেয়া যাবেনা।
আশা ছেড়ে দেয়া প্রমি এখন গানের জন্য গলা ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জীবন তো একটাই। এই একটা জীবনে করতে হবে অনেক কিছু, যেতে হবে অনেক দূর।
হ্যাঁ, অনেক দূর।


Comments

Popular posts from this blog

দ্বিধা !

সমাজ !

দৌড়া বাজান দৌড়া টাকার পিছে lyrics