জীবনের ভিন্ন এক মানে

ডিপার্টমেন্টের এক জুনিয়রের সঙ্গে দেখা। কথায় কথায় জানতে চাইলাম, পড়াশোনার বাইরে আর কী করো?
বললো, একদম সময় পাই না ভাইয়া।
- সময় পাওনা কেন?
-ডিপার্টমেন্টের পড়ার চাপ। লাইব্রেরীতে বিসিএসের পড়াশোনা।। সপ্তাহে তিনদিন আইএমএলে (ইন্সটিটিউট অব মডার্ণ ল্যাঙ্গুয়েজ) ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখার ক্লাস। দুটো টিউশনি। ওদিকে এক ভাইয়ের কাছে সামনের সপ্তাহ থেকে জিআরইও শুরু করবো ভাবছি।
.
আমি অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।
.
মাত্রই থার্ড সেমিস্টারে পড়ে। চোখেমুখে লেগে আছে মফস্বলের ছোঁয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশালতা অনুভবের এই তো শ্রেষ্ঠ সময়। অথচ কীভাবে যে এই বয়সেই ছেলেটার মধ্যে জাগতিক হিসেব-নিকাশ আর চাওয়া-পাওয়া ঢুকে গেল! দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন বৈষয়িক ছেলে-মেয়ের সংখ্যাই দিন দিন বাড়ছে।
.
এদের জন্যে ভীষণ মায়া হয় আমার। পাশ করে কী করবে, কোনদিকে আগাবে- বৈষয়িক এমন তাড়নায় এরা না পারে ক্যাম্পাস উপভোগ করতে, না পারে জীবনরে ফোকাস ঠিক করতে। মাঝখান দিয়ে চলে যায় বসন্তের দিন, বুকের গহীণে জমা হতে থাকে রাশি রাশি হতাশা।
এসব দেখে বড় জানতে ইচ্ছে করে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন মানে কী শুধুই দিনময় ক্লাসের পড়া আর এক্সামের টেনশনে নাওয়া-খাওয়া ভুলে অস্থিরতায় ভোগা? কেবল বিসিএস আর জিআরই প্রিপারেশন নেয়া? দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাস কী তাই বলে?
.
আমি নিশ্চিত জানি অপরাজেয় বাংলার সামনে দাঁড়িয়ে ওদের অনেকেই কোনদিনও অনুভব করতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধের মহত্ত্ব। টিএসসির সবুজ ঘাসে আড্ডা দিতে দিতে ভাবেনি সমাজ বদলের কথা। কার্জন হল কিংবা মধুর ক্যান্টিনের সামনে দিয়ে হেটে যাবার সময় ঐতিহ্য আর চেতনায় কখনোই শিউরে ওঠেনি শরীর। অথচ ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার পতনসহ জাতির সকল ক্রান্তিকালেই কী গৌরাবান্নিত অবদানই না রেখে গেছে এদের পূর্বসূরিরা!
.
পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ফুলার রোডের আড্ডা, চারুকলায় জলের গান, টিএসসিতে সংগঠন করাকে অনেকের কাছে সময় নষ্ট মনে হয়। এদের কাছে জীবনের মানে হলো দিন শেষে নিজেকে ভাল চাকুরে হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। বেতনের মাপকাঠিতেই এরা সাফল্য মাপে। ফলে ওদের অবসর মানে আইইএলটিএস, জিআরই প্রিপারেশন, সাইফুরস ম্যাথ শেষের বিশেষ তাড়াহুড়ো।
.
অথচ ক্লাস শেষে টিএসসিতে বন্ধুর মায়ের জন্য সাহায্যের টাকা তুলে, সন্ধ্যায় মল চত্ত্বরে ফুটবল খেলে, মধ্যরাতে পলাশীতে সমবেত কন্ঠে গান গেয়ে, ভোর হয় হয় রাতে যে ছেলেটাকে হলে ফিরতে দেখি ওর মধ্যেও আমি জীবনের ভিন্ন এক মানে খুঁজে পাই।
যে ছেলেটা নিজের রক্ত দিয়ে অন্যের জীবন বাঁচায়, যুক্তির ঝড় তোলে বিতর্কের মঞ্চে তার ভেতরে বেঁচে থাকতে দেখি সমাজ বদলের আশাগুলোকে।
.
সবাই কী ক্লাসে ফার্স্ট হতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে? কেউ কেউ তো জীবনের বহুরঙা ভিন্ন মানেও খুঁজে নেয়। ভরা পূর্ণিমায় বেড়িয়ে পড়ে জোছনাস্নানে। হেমন্তের সন্ধ্যায় খোঁজে শিউলি ফুলের ঘ্রাণ। শুধু বিসিএস কোচিং নয়, কারো কারো বুকের ভেতর নির্ঘুম জাগে অন্নহীন পথশিশুদের ভাগ্যবদলের স্বপ্নও ...।
.
জীবন এক বৈচিত্র্যময় অনুভূতির অ্যালবাম। টুকরো টুকরো গল্প, রঙ-বেরঙের স্মৃতি তাতে পূর্ণতা দেয়। সায়াহ্নে এসে সাবারই একবার উঁকি দিতে ইচ্ছে হয় অ্যালবামটাতে। ফেলে আসা পুরনো দিন দেখে কেউ তৃপ্তির নি:শ্বাস ফেলে, কারো আবার ঝরে আফসোসমাখা দীর্ঘশ্বাস...
প্রিয় অনুজ,
জীবনের অ্যালবামটা কতটা বর্ণিল গল্পে সাজাবে, এ সিদ্ধান্ত তোমার।
তবে মনে রেখো, চলে যায় হেমন্তের দিন, চলে যায় স্মৃতি তৈরির শ্রেষ্ঠ সময়...!


--লিখা: আব্দুল্লাহ আল ইমরান--

                                 

Comments

Popular posts from this blog

দ্বিধা !

সমাজ !

দৌড়া বাজান দৌড়া টাকার পিছে lyrics